যাকাত ও তার নেছাব

ভূমিকাঃ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের তৃতীয় স্তম্ভ হলো যাকাত। হিজরী ২য় সনে যাকাতের বিধান নাযিল হয়। এটি একটি আর্থিক ইবাদত। পবিত্র কোরআনে কারীমে যাকাতের বিধান অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। আল কোনআনের প্রায় ৩২টি স্থানে যাকাতের বার্তা এসেছে। ইসলামী সমাজকে দারিদ্র্যমুক্ত ও স্বাবলম্বী করার তাগিদে পবিত্র কোরআনে বারংবার যাকাতের তাগিদ প্রদান করা হয়েছে।

যাকাতের পরিচয়ঃ
যাকাত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। আর্থিক ইবাদত। সম্পদশালী ব্যক্তির জন্যে অপরিহার্য বিষয়। যাকাতের ফরজিয়্যাত ও গুরুত্ব কুরআনুল কারীমের অনেক আয়াত ও বহু হাদীসের দ্বারা প্রমাণিত। যদি কেউ যাকাত ফরজ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে সে আর ইসলামের গন্ডির ভেতর থাকে না, কাফের বলে গন্য হয়।

যাকাত শব্দটি আভিধানিক ভাবে পবিত্রতা ও বর্ধনশীলতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। যাকাত আদায় করলে কৃপনতার মত যঘন্য দোষ থেকে পবিত্রতা অর্জিত হয়। সাথে সাথে অবশিষ্ট সম্পদ পবিত্র হয়ে যায় এবং তাতে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। তাই এটা যাকাত নামে অভিহিত। আর পরিভাষায় যাকাতের সংজ্ঞা এভাবে করা হয়েছে, শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সম্পদের একটি অংশ হাশেমি কিংবা তদীয় গোলাম ব্যতীত অন্য কোন দরিদ্র মুসলমানকে আল্লাহ তায়ালার সন্তষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এমন ভাবে মালিক বানিয়ে দেয়া, যাতে যাকাত প্রদান কারীর জন্য উক্ত সম্পদ থেকে উপকৃত হওয়ার কোন সুযোগ না থাকে। অথবা সহজ ভাবে যাকাতের সংজ্ঞা এভাবে করা যায়, বয়প্রাপ্ত বিবেকবান মুসলিম ব্যক্তির নেছাব পরিমান বর্ধনশীল মালের উপর পূর্ণ এক চন্দ্র বছর অতিবাহিত হলে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধরিত অংশ যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে নি:স্বার্থ ভাবে মালিকানা অর্পন করাকে যাকাত বলা হয়।

নেছাবের পরিচয়ঃ
যাকাত সম্পদ শালীর উপর একটি ফরজ বিধান। তবে প্রত্যেক সম্পদশালীর উপর সমান ভাবে অপরিহার্য নয়। এর জন্য রয়েছে সম্পদের নির্দিষ্ট সীমারেখা ও নির্ধারিত পরিমান। যাকে নেছাব বলা হয়। এর উপর নির্ভর করে প্রতিটি আর্থিক ইবাদতের অপরিহার্যতা। নেছাব শব্দটি আরবী। যার আভিধানিক অর্থ আসল অবস্থা বা প্রত্যাবর্তন স্থল। শরীয়তের পরিভাষায় নেছাব বলতে এ পরিমান অর্থ সম্পদ বোঝানো হয়, যে পরিমান অর্থ সম্পদ থাকলে যাকাত ও ফিতরার ন্যায় আর্থিক ইবাদত আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যায়।

যাকাতের নেছাব:
যাকাতের নেছাবে হিসাব করা হয় চার প্রকার সম্পদ (১) সোনা ও রুপা (২) ব্যবসায়িক পন্য (৩) গবাদি পশু যা বছরের অধিকাংশ সময় মালিকের খাদ্য খাবার ছাড়াই মাঠে-ঘাটে চরে প্রতিপালিত হয় (৪) সাড়ে সাত তোলা সোনা কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য পরিমান নগদ টাকা পয়সা। নেছাব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সোনা-রুপা মান দন্ডের ভূমিকা রাখে। গবাদি পশু ছাড়া অন্য যে কোন সম্পদের নেছাব নির্ধারন করা হয় সোনা রুপার মূল্য মানের সাথে মিল রেখে সোনা-রুপার বিষয়টি মূল্যমান নির্ধারণের মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়।

সোনা-রুপার নেছাবঃ
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে একথা সর্বসম্মত যে, রুপার নেছাব দুইশত দিরহাম এবং সোনার নেছাব বিশ মিসকাল। আর গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত যে তোলা বা ভরি হিসেবে দুই শত দিরহাম সমান সাড়ে বায়ান্ন তোলা আর বিশ মিসকাল সমান সাড়ে সাত তোলা বা ভরি। সুতরাং যে ব্যক্তি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা কিংবা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের অথবা এর দ্বারা তৈরী অলংকারের মালিক হবে তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এমনি ভাবে কারো নিকট যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সম-পরিমান টাকা থাকে তাহলে সতকরা ২ টাকা ৫০ পয়সা হারে যাকাত দিতে হবে।

ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাতঃ
ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য যদি সোনা কিংবা রুপার নেছাব পরিমান হয়। পণ্য যে প্রকারেরই হোক না কেন, বছরান্তে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে। সুতরাং যদি কেউ গাড়ী-বাড়ী, জায়গা-জমি ইত্যাদি ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয় করে আর তার উপর এক বছর অতিবাহিত হয় তখন তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে। হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা:) বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা:) আমাদেরকে ঐসব সম্পদ থেকে যাকাত প্রদানের হুকুম করতেন, যে গুলো আমরা ব্যবসার জন্য প্রস্তুত করে রাখতাম। (আবু দাউদ হাদীস নং ১৫৬২)
বিভিন্ন প্রকার সম্পদের নেছাব নির্ণয়ঃ
কারো কাছে যদি কিছু সোনা বা রুপা, আর কিছু নগদ টাকা ও কিছু ব্যবসায়িক পণ্য থাকে, যে গুলোর কোনটাই পৃথক ভাবে নেছাব পরিমান হয় না। তবে সব গুলোর মুল্য একত্রিত করলে নেছাব তথা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য পরিমান হয় তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে। বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত জুবাইর ইবনে আব্দুল্লাহ (রহ:) বলেন হযরত সাহাবায়ে কেরাম যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে স্বর্ণকে রে․প্যের সাথে এবং রে․প্যকে স্বর্ণের সাথে মিলিয়ে নেছাবের হিসাব করতেন (বাদায়েউস সানায়ে ২য় খন্ড পৃ:৪২৩) যাকাত মূল বস্তু থেকে আদায় করতে হবে কি না? যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করতে ঐ সম্পদের অংশ দিয়েই আদায় করতে হবে না। টাকা বা অন্য কোন বস্তু দিয়ে আদায় করলে যথেষ্ঠ হবে। এ বিষয়ে ইমামগণের মাঝে যথেষ্ঠ মতভেদ আছে। মূলত: মতভেদের ভিত্তি হলো যাকাতের হাকীকত সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা। অর্থাৎ যাকাত কি কেবল ইবাদত, না কি ধনীদের সম্পদে আরোপিত দরীদ্রের হক? বাস্তবতা হালো যাকাতের মাঝে উভয় দিকেরই সম্ভাবনা বিদ্যমান।
ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ (রহ:) প্রমূখ যাকাতের মধ্যে ইবাদতের দিকটিকে প্রাধান্য দিয়ে বলেন, যে সম্পদের উপর যাকাত এসেছে সে মাল থেকেই যাকাত আদায় করতে হবে। পরিবর্তে টাকা-পয়সা বা অন্যকোন বস্তু
দ্বারা যাকাত আদায় করা অ‣বধ। অপরদিকে ইমাম আবু হানীফা (রহ:) ও তাঁর অনুসারী ইমামগণ গরীবের হকের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে মূল্য প্রদান করাকেও ক্সবধ বলেন।

পণ্যের পরিবর্তে মূল্য প্রদান বৈধ হওয়ার দলীলঃ
(১) ‘‘হে নবী আপনি তাদের (ধনীদের) মাল থেকে যাকাত উসুল করুন। ’’ সুরা তাওবা ১০৩। এ আয়াতে যাকাত হিসেবে মাল ব্যাপক অর্থ বোধক শব্দ। কীমত বা মূল্যও মালের অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং মাল না দিয়ে মূল্য দিলেও নির্দেশ পালন হয়ে যাবে। অনেক হাদীস থেকে প্রতিয়মান হয় যে, হযরত রাসুলে কারীম (সা:) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই মূল বস্তুর পরিবর্তে মূল্য বা অন্য কোন প্রয়োজনীয় বস্তু দ্বারা যাকাত প্রদানের প্রচলন চলে আসছে। যেমন (২) হযরত তাউস (রহ:) বলেন ‘‘হযরত মুয়ায (রা:) যখন রাসুল (সা:) কর্তৃক ইয়ামানের শাসন কর্তা নিযুক্ত হলেন, তখন তিনি ইয়ামান বাসীদের এ নির্দেশ দিলেন যে, তোমরা উৎপন্ন দ্রব্যের যাকাত জামা, চাদর ইত্যাদি কাপড় দ্বারা পরিশোধ কর আমি তা গ্রহণ করবো। কেননা এটা তোমাদের জন্য সহজ সাধ্য এবং যাকাত গ্রহন কারী মদীনা বাসী সাহাবীদের জন্যও অধিক উপকারী। (সহীহ বুখারী ১খন্ড পৃ:১৯৪) (৩) হযরত আতা (রহ:) বলেন হযরত ওমর (রা:) রুপা ইত্যাদির যাকাতের ক্ষেত্রে অন্যান্য আসবাব পত্র গ্রহন করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা) সদ্য প্রয়াত বিশিষ্ট ইসলামী ¯‥লার আল্লামা ইউসুফ কারজাভী (রহ:) দু’পক্ষের প্রমানাদি উল্লেখ করার পর বলেন ‘‘আমি মনে করি উভয় পক্ষের প্রমানের মাঝে চিন্তা ভাবণার পর আমাদের কাছে হানাফী মাযহাবের প্রাধান্য স্পষ্ট হয়েছে। (ফিকহুয যাকাত ২খন্ড পৃ:৮১৫) সংক্ষিপ্ত উক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, যে মালের উপর যাকাত এসেছে, তার পরিবর্তে তার মূল্য দ্বারা অথবা অন্যকোন প্রয়োজনীয় বস্তু দ্বারাও যাকাত আদায় করা বৈধ।

যাকাতের পরিচয়ঃ যাকাতের শাব্দিক অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। পবিত্র কোরআনে আভিধানিকভাবে উভয় অর্থে যাকাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যাকাতের শরয়ী অর্থ হলো মুসলমান প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ্যমস্তিষ্ক ব্যক্তির নিজ মালিকানাধীন সম্পদ যদি নেসার পরিমাণ হয় এবং তার উপর যদি এক বছর অতিবাহিত হয় এবং তার আড়াই শতাংশ সম্পদ শরীয়ত নির্ধারিত ভাতে গ্রহীতার ব্যক্তি মালিকানায় দান করে দেয়া। হাদীসে এসেছে যাকাত ধনীদের কাছ থেকে নেয়া হবে আর গরীবদের মাঝে বন্টন করা হবে। (বুখরী-ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত)

নেসাবের পরিমাণঃ নেসাব বলা হয় সুনির্দিষ্ট পরিমাণকে। শরীয়ত যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইসলামে যাকাতযোগ্য সম্পদ মোট চার প্রকার; সেগুলোর নেসাবও আলাদ আলাদা।
(১) সোনা-রুপাঃ স্বর্ণের নেসাব হচ্ছে সাড়ে সাত তোলা।

মাওঃ আব্দুল ওয়াহহাব সাহেব
নাজেমে তা’লিমাত অত্র জামিয়া

Loading